নোয়াখালীর আঞ্চলিক গানের প্রবাদপুরুষ শিল্পী মোঃ হাশেম এর গানে এমন কি আছে যা তাকে অঞ্চলের মনের মানুষের কাছে, আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা আর ভালোবাসায় অভিষিক্ত করেছে! এ বিষয়টি ভাবার আগে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, মোঃ হাশেম এর গানে কি নেই! আছে দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূলবর্তী ও মেঘনাপাড়ের মানুষের সুখ-দুঃখ আনন্দ বেদনা রীতি-প্রথা ভালো-মন্দ-শুভঅশুভ সংস্কার কুসংস্কার,ঐচিত্য-অনুঐচিত্য,নীতি-দুর্নীতি।এ সকলকিছু মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে শিল্পি মোঃ হাসেম এর গানে।
এক্ষনে আঞ্চলিক গানের এ প্রবাদপুরুষ শিল্পী মোঃ হাশেম এর জীবনকোষ্ঠিতে আলোকপাত করা যাক, গীতিকার সুরকার গায়ক ও গবেষক অধ্যাপক মোহাম্মদ হাশেম ১৯৪৭ সালের ১০ জানুয়ারি নোয়াখালী সদর থানার চরমটুয়া ইউনিয়নের শ্রীকৃষ্ণপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। নিজ গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নিয়াজ মোহাম্মদ হাইস্কুলে মাধ্যমিক পাস করে তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক সনদপ্রাপ্ত হন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই তার সঙ্গীত প্রতিভার উন্মেষ ঘটে। সঙ্গীতেও তার উচ্চতর ডিগ্রি রয়েছে। লোকসঙ্গীত সম্রাট শিল্পী আবদুল আলীম তার সঙ্গীত গুরু। ঢাকা মিউজিক কলেজে সঙ্গীতে ডিগ্রি নেয়ার পর তিনি সেখানেই বাংলা বিভাগ ও সঙ্গীতের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু মাটির সংগীতের টানে তিনি ঢাকা শহরে স্থিত হতে পারেন নাই। চলে নিজভূম নোয়াখালীতে, জীবিকার জন্য তিনি শুরু করেন অধ্যাপনা। প্রথমে কবিরহাট কলেজ,পরে নোয়াখালী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, লক্ষীপুর কলেজ হয়ে আবার নোয়াখালী কলেক থেকে ২০০৫ সালে অবসর গ্রহণ করেন।এরও আগে ১৯৭০ সালে রেডিও পাকিস্তানের ‘অনুষ্ঠান সংগঠক’ হিসেবে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন-এই হলো শিল্পি অধ্যাপক মোঃ হাসেম এর ছোটখাটো জীবনন্তিকা।
১৯৭৩-১৯৭৪ সালের দিকে মোহাম্মদ হাশেম নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় গান লিখতে শুরু করেন। এর আগে নোয়াখালী অঞ্চলের কোনো গান ছিল না। তার হাত ধরেই এ অঞ্চলের মানুষের মুখের ভাষা, আনন্দ-বেদনা, মেঘনা পারের মানুষের সংগ্রামী জীবনাচার সঙ্গীতে রূপ নেয়। তার অধিকাংশ গান সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে তুমুল জনপ্রিয়তা পায়।
নোয়াখালীর প্রধান সঙ্গীত খ্যাত ‘আঙ্গো বাড়ি নোয়াখালী রয়াল ডিস্ট্রিক ভাই/ হেনী মাইজদী চৌমুহনীর নাম কে হুনে নাই’-গানটি তাকে এনে দিয়েছিল জগতজোড়া খ্যাতি। এ গান আজও মানুষের মুখে মুখে। তার জনপ্রিয় অন্যান্য গানের মধ্যে রয়েছে- ‘আল্লায় দিসে বাইল্লার বাসা নোয়াখাইল্লা মাডি’, ‘নোয়াখালীর দক্ষিণে দি উইটসে নোয়া চর’, ‘রিকশাঅলা কুসকাই চালা ইস্টিশন যাইয়াম’, আহারে ও কুলসুম কতুন আইলো ডুবাইআলা কইল্লো এ জুলুম’।
সঙ্গীতের পাশাপাশি তিনি অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭০ সালে রেডিও পাকিস্তানের ‘অনুষ্ঠান সংগঠক’ হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু। পর্যায়ক্রমে ঢাকা সঙ্গীত কলেজ, কবিরহাট সরকারি কলেজ, লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজসহ দেশের বিভিন্ন কলেজে শিক্ষকতার পর তিনি ২০০৫ সালে এ অঞ্চলের অন্যতম নোয়াখালী সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তার সঙ্গীতের প্রথম গুরু বাংলা লোকজ সঙ্গীতের দিকপাল শিল্পী আব্দুল আলীম। তিনি আবদুল আলীম ছাড়াও ওস্তাদ বারীন মজুমদারের কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, ওস্তাদ আবিদ হোসেন খানের কাছে তত্ত্বীয় সঙ্গীত, ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খানের কাছে তবলায় দীক্ষা নেন। অবশেষে তিনি নিজ বাসভূমিতে গিয়ে শুরু করেন শিক্ষকতা ও সঙ্গীত সাধনা।
২০০৫ সালে একুশে বইমেলায় বের হয় এই সাধক পুরুষের গানের প্রথম সংকলন ‘নোয়াখালীর আঞ্চলিক গান’। ২০১৫ সালে তার রচিত বাছাই করা আড়াইশ’ গান নিয়ে উৎস প্রকাশন বের করে নির্বাচিত নোয়াখালীর আঞ্চলিক গান। মোহাম্মদ হাশেম ও নোয়াখালীর আঞ্চলিক গান এখন যেন সমার্থক।